ফাহাদ আল আব্দুলাহ’র ভৌতিক ছোটগল্প ‘অমর’
মরচে পড়া ভারী দরজাটা খোলার শব্দে নিঃস্তব্ধ জেলখানার অন্তরাত্মা যেন কেঁপে ওঠে। দরজার বাইরের হলদে আলো অন্ধকার ঘরটার ভেতরে সলজ্জ্ব কিশোরীর মত উঁকি দেবার চেষ্টা করে, কড়িকাঠ পেরোতে পারেনা। দূরে ডেকে ওঠে একটা লক্ষ্মী পেঁচা। শামীম আহমেদ এই কাজ করছেন আজ প্রায় ৩০ বছর। মাথার ওপরে পাতলা হয়ে আসা চুল আর তাতে ধূসরের অনধিকার প্রবেশে সেটা কাউকে বলে দিতে হয়না। কারাগারের অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে উনার। করিডোরের হলদে আলো অন্ধকার কাটতে না পারলেও তাঁর বুড়ো চোখে কোণায় নিঃসাড় বসে থাকা লোকটাকে খুঁজতে অসুবিধে হয়না।
হাঁটু মুড়ে, তার ওপর থুতনি রেখে বসে আছে লোকটা। চুলগুলো শামীম সাহেবের মতই ধূসর। চোখ বন্ধ করে গুন গুন করছে সুর ভাঁজছে। চেনা সুর। কিছুটা শুনলে বোঝা যায়। আমি তো মরে যাবো গানের সুর চোখ বুঁজে ভাঁজছে লোকটা, হাত দুটো জড়িয়ে রেখেছে হাঁটুজোড়া।
‘জব্বার!’ হাঁক ছাড়েন জেলার শামীম আহমেদ।
গুনগুন করে সুর ভেঁজেই চলেছে লোকটা।
‘জব্বার।’ গলা চড়ান জেলার। কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ‘কয়েদি ৪২৩৬৬৭!’
চমকে চোখ তুলে তাকায় লোকটা। চোখের আশেপাশে বার্ধক্যের ছাপ পড়েনি। অন্ধকারের সাদা দাঁত দেখা দেয়। হাসছে। ‘আরে জেলার সার, আসেন সার, বসেন!’
ঠোঁটদুটো শক্ত হয়ে ওঠে শামীম আহমেদের। ঘড়ির দিকে তাকান। কেন জানেন না এই কয়েদির সামনে আসলে তিনি এ্যট ইজ পজিশনে দাঁড়িয়ে যান। লোকটা উনার দিকে তাকিয়ে তখনো হাসছে, কিন্তু চোখদুটো নিষ্প্রাণ। দেখলে মনে হয় বহু পুরনো লাশ তাকিয়ে আছে।
‘আর ৩০ মিনিট, জব্বার।’
অন্ধকারে ওর সাদা দাঁত যেন আরো বেশি আলো ছড়াতে থাকে। খিক খিক করে হাসে জব্বার।
‘কী খেতে চাও?’
‘ডিমভাজি আর খিচুড়ি স্যার।’ অভ্যস্ত কণ্ঠে জবাব দেয় কয়েদি ৪২৩৬৬৭। শামীম আহমেদ ভেতরে ডাকেন একজনকে।
‘দৌড়াদৌড়ির দরকার নাই সার।’ দাঁত বের করে আবার হাসে জব্বার, ‘রেখে দেন, আমি উঠলে পরে খাবো’
‘উঠলে খাবে মানে?’ ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করেন শামীম, ‘আধা ঘণ্টা পরে ফাঁসির অর্ডার, উঠে এসে খাবে মানে? কনডেমন সেলে তোমাকে এক্সপায়ারড গাঁজা দিচ্ছে কে?’
পুরো জেলখানা কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে ওঠে কয়েদি ৪২৩৬৬৭।
‘আপনার ঝোলানো নিয়ে তিনবার হবে সার। এখনো এখানেই আছি। ভরা পেটে ফাঁসিতে ঝুলতে নাই সার, একেবারে ইজ্জতের ব্যাপার, সার।’
বিষ্ফোড়িত চোখে কয়েদির দিকে চেয়ে আছেন জেলার শামীম। এই কয়েদির চোখ কখনই চঞ্চল হয়না, এখনও মণি বড়ো হয়নি, নেশা করার কোন লক্ষণই নেই। তখনও বকে চলেছে কয়েদি ৪২৩৬৬৭।
‘বেশি মনে নাই সার, একদিন হঠাৎ চোখ খুলে দেখি চারিপাশে অন্ধকার। আমার উপরে মাটি, পেটে ক্ষিদা। নড়তেও পারিনা। চোখ খোলা না বন্ধ সেটাই বুঝতে পারলাম না, এমন অন্ধকার। পেট খালি, ঐ অবস্থায়ই হাত নাড়ার চেষ্টা করলাম সার। টাইট করে চাদর মোড়ানো। হঠাৎ পাশে থেকে কে যেন বললো সার, আমি খুড়তেছি, তুই পালা। একটু আলো দেখলাম সার, ঐ আলো বরাবর ঠেলে, ধাক্কায় মাটির উপরে চলে আসলাম, সার। বের হয়ে দেখি আমার গ্রামের কবরস্থান। বুক ভরে শ্বাস নিলাম। পেটে ভীষণ ক্ষিদা। বাড়ী গেলাম পথ চিনে, মায় আমারে দেখে দিল ভাগায়, পুরা গ্রামের সবাই আমাকে দেখে ভয়ে পালায়। শেষে আমিই গ্রাম ছাড়লাম, সার।’
একটানা বলে কিছু সময় থামে কয়েদি ৪২৩৬৬৭। শামীম আহমেদের মুখে কথা সরছেনা। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছেন এখন। পা দুটোকে সেদ্ধ নুডলসের মত মনে হচ্ছে তাঁর।
‘প্রথম মানুষ মারসিলাম উত্তরে, সার। গাইবান্ধা। তখন নাম জব্বার ছিলোনা, কী নাম নিসিলাম মনেও নাই। কয়েদি নম্বর মনে আছে, ১৭৪৯৮৭। আপনের মতই, সার, সাড়ে এগারোটার সময় আইসা খাইতে দেয়। খচ্চর ছিল জেলার সাব। কথা বার্তা কয় নাই। ঝুলায় দিল। রাস্তায় কফিনে জ্ঞান ফিরে, সার। পায়জামা শেষ, হাত-পা নাড়াইতে একটু কষ্ট হইসিলো, রগ কাইটা দিসিল তো।’
এই বলে দুই হাত উঁচু করে রগের জায়গা দেখায় কয়েদি ৪২৩৬৬৭। সেরে ওঠা দগদগে ক্ষত। চামড়া আর মাংস বিশ্রি ক্ষতটার একটা চিরস্থায়ী স্মৃতি তৈরি করেছে।
‘পরের বারে আবার নাম বদলায় দক্ষিণে চলে গেলাম। পাহাড়ে গেলাম। এইবার, এইবার আমি এমনিতেই লোকটাকে মাইরা ফেললাম। হারামি, বৌ এর গায়ে হাত তোলে……’
এতক্ষণ বাদে কয়েদি ৪২৩৬৬৭ এর চোখ জোড়া যেন ধ্বক করে জ্বলে উঠলো। যেন প্রমাণ করতে চায় কয়েদি মৃত নয়, এখনও বেঁচে আছে, এখনো অনুভূতি আছে।
‘……তিন সাক্ষীর সামনে সোজা ঘাড় ভেঙ্গে ফেলসি, পুলিশ আসলো, ধরা দিলাম। এইবারও ফাঁসি। ঐবারে কয়েদি নম্বর ৭৩২২৪৯। জেলার সাব আমার কথা শুনলেন এইবার, কফিনে সাথে গেলেন, মর্গে যাবার আগেই চোখ খুললাম, সার। জেলার সার দেইখা পালাইলেন। দেইখা আমার মায়ের কথা মনে পড়লো, সার। আমার মাও এমনেই পালাইসিলো……”
শামীম আহমেদ থামিয়ে দিলেন কয়েদি ৪২৩৬৬৭ কে। ফাঁসির আসামী কম দেখেননি। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আবোল তাবল বকছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন তিনি জব্বারের দিকে। জব্বার আবার আগের ভঙ্গিতে হাঁটুতে মুখ গুঁজে গুন গুন করে সুর ভাঁজতে শুরু করেছে।
শামীম আহমেদ আর কিছু বললেন না। মাথায় একটু হাত রেখে বেরিয়ে গেলেন। যাবার আগে প্রহরীকে বলে গেলেন গরম ডিম ভাজা আর খিচুড়ীর ব্যবস্থা করতে। কয়েদি ৪২৩৬৬৭ এর শেষ ইচ্ছে।
নিজের অফিসে পৌঁছে টেবিলে কনুই ভর করে দুহাতে মুখ ঢেকে বসে আছেন শামীম আহমেদ। রাত বাজে পৌনে বারো। আর কিছু পরেই কয়েদি ৪২৩৬৬৭ এর ভবলীলা সাঙ্গ হচ্ছে।
দ্রুত কয়েদি ৪২৩৬৬৭ এর ফাইল বের করলেন। কোন ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই, যাকে খুন করেছে, চাইল্ড মলেস্টার। কিন্তু আর কোন রেকর্ডও নেই। আইডি কার্ড, ভোটার পরিচয় কিচ্ছু না। বছর দুয়েক আগে শহরে দুম করে উদয় হয়েছিল যেন।
ফোন ঘোরালেন। দেশের উত্তরের জেলগুলোতে খোঁজ নিতে।
তিন জেলে ফোন করলেন। দুটোতে ধরলোনা। তিন নম্বরে পেলেন। ঘুম ঘুম কণ্ঠে তরুণ জেলার জানালেন ১৭৪৯৮৭ নম্বর কয়েদি লোকাল প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টারের মাথায় পাথর মেরে খুন করে। পুলিশে ধরা দেয়। ওপেন এ্যান্ড শাট কেস। ফাঁসি হয়েছে, মৃত্যু নিশ্চিত করতে রগ কাটা হয়েছে। মর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপরে আর কোন রেকর্ড নেই। বিনীত কণ্ঠে তরুন জেলার এটাও জানাতে ভুললো না যে সে নতুন, ফাইলের বাইরে সে কিছু জানেনা। কয়েদি দেখতে কেমন সেটা তার একেবারেই জানা নেই।
ফোন রেখে স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন শামীম আহমেদ।
‘মানে রিটায়ারমেন্টের আগের সপ্তাহেই এই ঝামেলা আমার ঘাড়ে এসে পড়তে হবে?’ বিড়বিড় করেন শামীম আহমেদ।
খুট খুট শব্দ হয় দরজায়। আর্দালি এসেছে। জল্লাদের অর্ডার, জেলারের সিগনেচার দরকার। সিগনেচার নিয়ে চলে যায় আর্দালি। রাত বাজে ১১.৫০।
আবার ফোন করেন শামীম আহমেদ। এবার পাহাড়ের জেলে। কয়েদি ৭৩২২৪৯ আসলে কে?
পাঁচ জেলারের পর, আবার ও আরেক তরুণ জেলারের কাছেই সন্ধান পেলেন। ছোকড়া নিজেই ফোন করেছে।
‘এটা একটা বেশ স্ট্রেনজ কেইস ছিল, আহমেদ স্যার।” ছোকড়ার কণ্ঠে দ্বিধা। ‘বলা হচ্ছে, আমার প্রিডেসেসরের রিপোর্ট, এই কেস উনি আসারও আগের। ডমেস্টিক অ্যাবিউজের কেসে স্পাউজ আননোন এসেইলেন্টের হাতে ছুরি খায়। অ্যাসেইলেন্টের নাকি অ্যারেস্ট হবার সময় হাসতে হাসতে বলেছিল যতই ঝুলানো হোক ওকে মারতে পারবেনা। তো সেই কয়েদির সময় যিনি জেলার ছিলেন হি বিকেম এ্যান এলকোহুলিক, স্যার।” শেষ কথাটা ফিসফিস করে বলে তরুণ।
‘অ!’ শুধু এটুক বলেই ছেড়ে দেন প্রবীন জেলার শামীম আহমেদ। যার কথা হচ্ছে তাকে আগে থেকেই চিনতেন তিনি। ব্রাইট ছেলে, বোতলের তলায় ডুবে গেছিল একদম। চাকরিটা গেছে।
ফোন ছেড়ে চুপ করে বসে থাকেন শামীম আহমেদ। ঘড়ির দিকে তাকায়ন। সাড়ে বারো বাজে, ফাঁসি হয়ে গেছে কয়েদি ৪২৩৬৬৭ এর। অফিসের বাইরে আসেন, মর্গের উদ্দেশ্যে বের হওয়া গাড়িটার টেইল লাইট দেখেন উনি।
চোখ খুলে আবারও অন্ধকারের দেখা পায় কয়েদি ৪২৩৬৬৭। আঙ্গুল নাড়ানোর চেষ্টা করে, পারছেনা। বাইরে শুনতে পাচ্ছে গাড়ির শব্দ জেলের সদর দরজা বন্ধ হবার আওয়াজ।
সমাপ্ত
লেখক: ফাহাদ আল আব্দুল্লাহ
তাঁর বইসমূহ:
দ্য গিভার
১০০০ গজ
Comments (0)