সালেহ আহমেদ মুবিন-এর ‘মহাপ্রাণ’

 

সমস্যাটা হুট করেই শুরু হয়েছিলো। সমস্যা বলা ঠিক কি না তাও বুঝতে পারছি না। ভ্রু কোঁচকাচ্ছো নিশ্চয়ই। ব্যাপারটা খুলে বলি তবে।

গত মঙ্গলবারের কথা। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বই পড়ছি। স্কুল কী কারণে বন্ধ, আর বাইরে যেতে ইচ্ছে হলো না। আলস্য চেপে ধরলো। দিনটাও মেঘমেঘ। উত্তরের জানালা দিয়ে খোলা বাতাস বইছে। জানালা দিয়ে তাকালে একটা দিঘীমতো চোখে পড়ে। টলটলে স্বচ্ছ জল। চোখে দেখতেও আরাম।

পরিবেশটা আরো আরামদায়ক করার জন্য হাতে একটা বই তুলে নিলাম। খুব ইন্টারেস্টিং বই। আলাভোলা একটা চরিত্র যে কিনা সবার সাথে ফাজলামো করে অনেক কিছু ঘটিয়ে ফেলে। অদ্ভুত ধরনের বই।

ঠিক তখনই হঠাৎ মনে হলো পায়ের কাছে পড়ে থাকা ব্যাগটা নড়ে উঠলো। আমি চট করে তাকালাম। না, কোনো নড়াচড়া নেই। পড়ায় মনোযোগ থাকায় চোখের কোনায় ধান্ধা দেখেছি। এ ব্যাপারটা খুব সহসাই হয় সম্ভবত। সবার ক্ষেত্রেই। মানুষের মন আর মস্তিষ্ক যেহেতু প্রচণ্ড বিস্ময়কর দুটো বস্তু, তাই এরা সবসময়ই মানুষটাকে নিয়ে নানান খেলা খেলে। হয়তো ঘুমিয়ে আছেন, মনে হবে ঘরে যেন কে। চোখ খুলেই বুক ধ্বক করে উঠবে। চারপাশ নীরব নিস্তব্ধ। চেয়ারে জবুথবু হয়ে কে যেন বসে আছে। এখনই মুখ তুলে ক্ষীণ গলায় কিছু একটা বলবে। এমন কোনো কথা যা শুনে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যাবে। কোনো এক সুপ্রাচীন অশরীরী নরকের গভীর খাদ থেকে পথ ভুলে যেন চলে এসেছে আপনার ঘরে। মুহূর্তখানেক এই সুররিয়াল জগতে হাবুডুবু খাবেন আপনি।

এরপর চট করেই পুরোপুরি ধাতস্থ হয়ে যাবেন। দেখবেন চেয়ারে অগোছালো কিছু কাপড় পড়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন কেউ বসে আছে। আশেপাশে অনেক খুটখাট শব্দও শোনা যাবে এবার। দূরের মেইন রোডের কোনো গাড়ির হর্নের মৃদু শব্দ। বা বাসার বাইরের ব্রিটিশ আমলের ল্যাম্পপোস্টে হয়তো রাস্তার কুকুর গা ঘষছে। কানের কাছে মশার খানিক গুণগুণ শুনলেও অবাক হবেন না। পরবাস্তব জগত থেকে ধাক্কা দিয়ে আপনাকে বাস্তব জগতে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

সুতরাং ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক যে ব্যাগের নাড়াচাড়া আমি খুব একটা গা করবো না। পড়তে পড়তে আলস্যে খানিক ঘুম চলে আসলো। রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো অবস্থা–

হাওয়া উঠেছে শিশিরে শিরশিরিয়ে,
শিউলির গন্ধ এসে লাগে।
যেন কার ঠান্ডা হাতের কোমল সেবা।
আকাশের কোনে কোনে সাদা মেঘের আলস্য-

ঘুম ঘুম চোখে মাথায় কবিতা ঘুরছে। আশ্চর্য, ফুলের ঘ্রাণও যেন পাচ্ছি। তখনই আবার চোখের কোনায় মনে হলো ব্যাগটা নড়ছে। আমি আধোঘুমে ভাবছি ভেতরে কোনো ইঁদুর ঢুকলো নাকি আবার। এরপর মনে হলো ব্যাগটা যেন মৃদু নড়াচড়া বাদ দিয়ে রীতিমতো মানুষের মতো উঠে দাঁড়িয়েছে। আমি বোধহয় ঘুমের মাঝেই অবাক হলাম। কিন্তু এই নিদারুণ আরামদায়ক আলস্যে আসা ঘুমে তা ব্যাঘাত ঘটাতে পারলো না। ব্যাগের চিন্তা বাদ দিয়ে ঢলে পড়লাম প্রবল ঘুমে।

***

ঘুম ভাঙলো ঠিক কখন তা বুঝে ওঠা গেলো না। চারপাশে অন্ধকার তা ঠিক। দীঘির দিকে কিছু জোনাকি ঘোরাফেরা করছে দেখতে পাচ্ছি। অপরপাশে রাস্তার প্রাচীন ল্যাম্পপোস্টটার হলদেটে আলোর প্রতিফলন জানালা গলে ঘরে এসে ঢুকেছে।

উঠে লাইট জ্বালালাম। শরীর টানা দিয়ে মনে হলো কত সহস্র বছর পর যে এভাবে মরার মতো ঘুমুলাম।

বাবা-মা গেছে ব্যাংকক। বাবার ব্যবসার কিছু কাজ আছে বোধহয়। মা-ও ভাবলো এই ফাঁকে একটু ঘুরে আসা যাক। তবে এতে আমার কোনো অসুবিধা হয় না। আমাদের বাবুর্চি আছে, রান্নাবান্না সব তিনি সামলে ফেলেন। কেয়ারটেকার আছেন, তাকে বাবা ডাকেন জগলুল। কোনো প্রয়োজন হলে তাকে বললেই সব পাওয়া যাবে। তবে জগলুল সাহেবের আসলে নাম সম্ভবত ভিন্ন কিছু। ছক্কু বা টিক্কু টাইপের কিছু। সেজন্য বোধহয় নামটা পালটে দেওয়া হয়েছে। জগলুল সাহেবকে সেজন্য আনন্দিতই মনে হয়। কেউ তাকে নাম ধরে ডাক দিলেই তিনি দাঁত বের করে তৃপ্তির হাসি হাসেন।

কিচেনে ঢুকে চা বানানোর সরঞ্জাম খুঁজতে লাগলাম। চা খেতে হবে এখন এক কাপ। এই রান্নাঘরটা বড়ো কোনো রান্নায় ব্যবহার করা হয় না৷ মূল রান্না হয় বাইরের ঘরে। সেখানে আলাদা রান্নাঘর আছে। তখন আবার চোখের কোনায় মনে হলো কোনো নাড়াচাড়া চোখে পড়লো। রান্নাঘরেই ইঁদুরের আবাস হবার সম্ভাবনা বেশি। খেয়াল হলো যে ঘুম থেকে উঠবার পর ব্যাগটা আমার পায়ের নিচে ছিলো না আর। অত খেয়াল করিনি তখন। এখন হঠাৎ ব্যাপারটা মাথায় আসতেই বুঝতে পারলাম। একটু চিন্তিত বোধ করছি। ওপরের তাকের কাচের বয়ামটা বোধহয় নড়ে উঠলো একটু আবার। আমি তাকিয়ে দেখলাম। কোনো ইঁদুর চোখে পড়লো না।

মাথা থেকে এসব চিন্তা সরিয়ে চায়ের দিকে নজর দিলাম। চা বানানোর মূল ব্যাপারটা হচ্ছে পানির মধ্যে। অনেকক্ষণ ধরে জ্বাল দিয়ে এরপর পাতি ঢালতে হয়। আমি চা ভালো বানাতে পারি। পাতি দিয়ে জ্বাল করে ছেকে নিয়ে দুধ মিশিয়ে আবার চুলায় বসিয়ে দিলাম। দেখলাম আমার ব্যাগটা তখন কিচেনে এসে অপর চুলায় আরেকটা পাতিল বসিয়ে দিলো। কাঁধে ঝুলানোর ফিতাগুলো দিয়ে হাতের কাজ করছে। সেটি আমাকে দেখে মাথা নাড়ার মতো একটা ভঙ্গি করলো। আমি একটা হাই তুলে মাথা নাড়লাম মৃদু। এরপর চায়ে দুধ মিশাতে থাকলাম। পাক্কা দেড় মিনিট ধরে দুধটা নাড়ালাম। আর তখনই হঠাৎ টের পেলাম কী ভয়ানক একটা ব্যাপার ঘটে গেছে। আমি চমকে উঠে তাকিয়ে দেখি ব্যাগটা রীতিমতো বেটে মানুষের মতো দাঁড়িয়ে চা বানাচ্ছে। আমি আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলাম। তার মধ্যেই মনে হলো ব্যাগটা যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। সেটিও আমাকে দেখে এবার আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলো। কীভাবে করলো তা ভাবার আগেই দুম করে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলাম আমি।

***

চোখ খুলে আবার সাথে সাথে বন্ধ করে ফেললাম। চারপাশে তীব্র অন্ধকার। কিংবা শূন্যতা। কারণ পিঠের নিচে কোনো কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করছি না।

অন্ধের মতো হাতড়াচ্ছি চারপাশে। বুক ধকধক করছে। হঠাৎ করে উদ্ভট এক অস্বাভাবিকতার মুখোমুখি হলে একরকম বিহ্বলতা কাজ করে। আমার অবস্থা হয়েছে সেরকম। কী ঘটছে কিছু বুঝতে পারছি না।

চোখ খুলে তাকালাম। নিকষ কালো আঁধার। ঠিক তখনই একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো। কে যেন খুকখুক করে কাশছে। কিন্তু কাশির আওয়াজটা গমগম হয়ে শোনাচ্ছে।

আমি ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠলাম, “কে…কে?”

মনে হলো কাশির মালিক হঠাৎ চমকে গেছে। গমগমে বিস্মিত স্বর শোনা গেলো, “কে… কে কথা বলে? কী অদ্ভুত!”

আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কিন্তু মনে হলো গমগমে স্বরের মালিকের আশেপাশের কেউ তার কানে ফিসফিস করে কিছু বলছে। লোকটা মনে হয় এবার বুঝতে পারছে ঘটনাটা। চাপা স্বরে বলে উঠলো, “এটা আমাকে দ্রুত বলবে না? আমি এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বৃহৎ সৃষ্টি। আমার একটা ভাব আছে না? এখানে কেউ এসে উপস্থিত হলে হুট করে গমগমে স্বরে আত্মা উড়িয়ে দেয়া কিছু কথাবার্তা বলে আমার ক্ষমতা প্রদর্শন করতে হবে। এই ব্যাপারটুকু বোঝো না?”

গলার স্বর শুনে লোকটার একটা অবয়ব আমার কল্পনায় ভেসে উঠলো। বিশাল এক অবয়ব। চোখমুখে শুভ্র দাড়িতে ঢেকে আছে। গা থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে মৃদু আভা৷ আবার মনে হলো কেউ তার কানে কানে ফিসফিসিয়ে কিছু বলছে।

গমগম স্বরের মালিকের বিরক্ত কণ্ঠ শোনা গেলো এবার। “মেকআপ করে আমি দেরি করে ফেলেছি মানে কী! আমার মতো একজনের সাক্ষাৎ লাভ করবে একজন আর আমার নিজেকে উপস্থাপনের একটা ব্যাপার আছে না? আমি কি যে সে কেউ নাকি! বলেছি না এ আসবার আগে আমাকে জানাবে! কী বললে? আমার কথা শুনতে পাচ্ছে? কীভাবে শুনতে পাবে?”

আমি পুরো হতভম্ব হয়ে বসে আছি। কোথায় এসে উপস্থিত হলাম!

কিছুক্ষণ বিরতি। এরপরই হঠাৎ একটা গমগমে স্বর বলে উঠলো, “কে? এই অসাধারণ মাত্রায় কার অনুপ্রবেশ ঘটেছে?”

আমি দ্বিধান্বিত বোধ করলাম। “একটু আগে আপনারা বললেন না যে আমি যে এখানে উপস্থিত হবো তা আপনারা জানেন?”

মনে হলো গমগমে স্বর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। কিন্তু সামলে নিয়ে বললো, “এত স্পর্ধা কার মহাপ্রাণের সামনে এভাবে কথা বলে?”

আমি হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বললাম, “আচ্ছা কী বলবেন বলুন।”

বোঝাই যাচ্ছে এই লোক বা যা-ই হোক, তার লক্ষ্য একটা বিশাল বক্তৃতা দেয়া। তা-ই দিক বরং।

“এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব হচ্ছে মহাপ্রাণের অংশ। আশেপাশের সব গাছ, ঘাস, মৃত্তিকা কণা বা পাথর, সবই মহাপ্রাণ…”

আমি একটা হাই তুললাম। বোঝাই যাচ্ছে মুখস্ত বক্তৃতা দিচ্ছে। আমি এখানে এসে উপস্থিত হবার আগে সম্ভবত রিহার্সাল করছিলো। কিন্তু আমি আসলে কোথায়?

“…মহাপ্রাণ অনন্তকাল পরে আবার জেগে উঠছে। একটু একটু করে, প্রতিনিয়ত। তোমরা মানবসম্প্রদায় মহাপ্রাণকে দীর্ঘ যন্ত্রণা ভোগ করিয়েছ। এবার সব ফেরত দেবার পালা…”

আমি হুট করে বলে উঠলাম, “মহাপ্রাণ? মানে এখন নিশ্চয়ই বলবেন না যে গাছের মতো পাথরেরও প্রাণ আছে।”

সত্তাটাকে বিরক্ত মনে হলো। “হে বোকা মানব, সবকিছুরই প্রাণ আছে। সবকিছুই জীবন্ত, সবকিছুই মহাপ্রাণের অংশ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব কোনে সে ছড়িয়ে আছে। তোমাদের সুদিনের অবসান হয়েছে। মহাপ্রাণ জেগে উঠে তোমাদের সবাইকে বিলুপ্ত করে দেবে।”

“কিন্তু সব মহাপ্রাণের অংশ হলে আমরাও তো তার অংশ। আমাদেরকে বিলুপ্ত করবে কেন?”

“কারণ তোমরা মহাপ্রাণকে বিনাশ করে চলেছ সবসময়। পাথর থেকে জল, সুতা থেকে লৌহ, সবকিছুই তোমরা ক্ষয় করে চলেছ। তাই মহাপ্রাণ জেগে উঠে বিনাশ করে দেবে সব।”

“আচ্ছা।”

আমার নিষ্প্রাণ বক্তব্যে বোধহয় সত্তাটা আবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে। বুঝতে পারছে না কী বলবে। খানিক পর অবশেষে বললো, “ধ্বংসের জন্য প্রস্তুত হও। প্রস্তুত হও জীবন্ত দুঃস্বপ্নের জন্য।”

এতক্ষণ ভয় না লাগলেও অদ্ভুত কোনো কারণে এবার কেন যেন গা শিউরে উঠলো। হঠাৎ করেই ভয় অনুভব করতে শুরু করলাম। তীব্র ভয়। মনে হচ্ছে চেতনা হারাচ্ছি। অন্ধকার বলে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু মনে হচ্ছে চারপাশে আলো থাকলেও তা এখন আমার কাছে অন্ধকার হয়ে আসতো। এর মাঝেই আবার আগের মতোই কথাবার্তা শুনলাম।

সত্তাটা বলছে, “ধুর আলো জ্বালানোর কথাই তো ভুলে গেছি। তোমরা আমাকে একবার মনে করিয়ে দেবে না? এত সময় ধরে মেকআপ নিলাম! এই ছোকরাকে তো ভয় দেখানোই গেলো না যথার্থ। তোমরা একেকটা অকর্মার ঢেঁকি!”

মনে হলো অপরপাশে কেউ কিছু একটা বললো। আমার অবশ্য চারপাশের বোধ অনেকটাই চলে গেছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে শুনতে পেলাম সত্তাটা বলছে, “তা ঠিক আছে যে এরা শিঘ্রই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু তার মানে এই না যে আমার ভাবটুকু নেবো না আমি!”

আমার এই অবস্থাতেই মনে হলো সত্যিই আমাদের সামনে কোনো মহাবিপদ। দুঃস্বপ্নের মতো ধেয়ে আসছে প্রচণ্ড অশুভ কিছু। যা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।

***

ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। নিজেকে আগের জায়গাতেই আবিষ্কার করলাম। মানে ভয়ে অজ্ঞান হবার আগে যে কিচেনে ছিলাম সেখানে। আমার দিকে জগলুল সাহেব উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছেন। উঠে বসতেই তার মুখে তেলতেলে হাসি ফুটে উঠলো।

“ভয় খাইছেন ভাইসাহেব? মাকড়সা দেইখা অজ্ঞান হয়ে গেছেন?”

আমি বিরক্ত বোধ করলাম। আমার অজ্ঞান হয়ে যাওয়া মনে হচ্ছে তার খুব সুখের কোনো ঘটনা।

“আরে নাহ! বিশ্বাস করবেন না! আমি চা বানাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি আমার স্কুলব্যাগটা এখানে আপনাআপনি হাঁটতে হাঁটতে এসে চা বানানো শুরু করেছে। দেখুন ঐ চুলায় এখনো পাতিলটা রয়ে গেছ।”

জগলুল সাহেব হাসি থামালেন একবার। এবার মনে হচ্ছে তিনি সত্যিই উদ্বিগ্ন। দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, “স্কুলব্যাগ চা বানাইতেছিলো? আর কিছু দেখেন নাই? ভেতরের বই খাতাগুলা কী করতেছিলো? বিস্কুট নিয়া আসতে গেছিলো না?”

বলেই আবার হাসতে শুরু করলেন তিনি। আমি বিরক্ত বোধ করলাম। উঠে নিজের রুমের দিকে এগোলাম এবার। মনে হচ্ছে মাথায় কোনো সমস্যা হয়েছে। উল্টাপাল্টা জিনিসপত্র দেখছি। অজ্ঞান হয়েও উদ্ভট একটা স্বপ্ন দেখেছি। মানুষ অজ্ঞান হলেও স্বপ্ন দেখে? ব্যাপারটা জানা ছিলো না।

জগলুল সাহেব পেছন থেকে বললেন, “কাউকে পাঠিয়ে দিবো? সাথে থাকবেনে। ভয় পাইছেন এমনিতেই।”

আমি কিছু বললাম না। রুমের দরজা লাগিয়ে দিলাম।

কিন্তু ভেতরে ঢুকতেই আবার ভয়ভয় করতে শুরু করলো। প্রতিটা বস্তুর প্রতিই এক ধরনের বিজাতীয় ভয়। জোর করে সে চিন্তা দূর করে দিলাম। স্কুলব্যাগটাও এখানে আছে। বিছানার নিচে পড়ে ছিলো বলে হয়তো আগে দেখিনি। কোনো কারণে বোধহয় ঘুমুবার পরও মস্তিষ্ক উত্তেজিত ছিলো। সেজন্য হ্যালুসিনেশন হয়েছে বা কিছু একটা। যা ঘটে গেছে আজকে তার কোনোটাই বাস্তব হতে পারে না। যৌক্তিক নয় তো বটেই।

সাহস পেলাম বেশ।

বিছানায় গিয়ে বইটা তুলে নিলাম। এরপর কতক্ষণ পার হয়েছে তা বলতে পারবো না।বই শেষ করার পর হুশ হলো। রাত বেশ গভীর হয়েছে। অবাক হলাম খানিকটা। খেতে ডাকেনি কেউ আমাকে। তা না ডাকুক। এমনিতেও ক্ষুধা লাগেনি। ঘরের লাইটটা নেভাতে ইচ্ছে হলো না। এখনো কি ভয় রয়ে গেছে? বিরক্ত বোধ করলাম নিজের প্রতি।

শুয়ে পড়লাম। রাতের আওয়াজ কানে আসতে শুরু করেছে এখন। সহজে ঘুম আসবে না বোধহয়। দিনে অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি। বাইরে ঝিঁঝিপোকা ডাকছে। বাতাসে গাছে পাতার শব্দ হচ্ছে শনশন। শীতের বেশ দেরি। তাও কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। বাইরে ল্যাম্পপোস্টটায় কিছু একটা লেগে টুক করে ধাতব শব্দ হলো। পেঁচা ডেকে উঠলো দূরে কোথাও। ধাতব শব্দটা এখনো হচ্ছে। মটমট ধরনের একটা শব্দ। যেন কেউ ইস্পাত বাঁকাচ্ছে।

এমনিতেই ঘুম আসছে না। শব্দে আরো বিরক্ত বোধ করলাম। উঠে এগিয়ে গেলাম জানালার কাছে। আর সাথে সাথে মনে হলো তা না করলেই বোধহয় ভালো হতো।

পুরো রাতটা এক বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। কল্পনা করুন আপনার বাড়ির সামনের আঙিনাটা। সেখানকার প্রতিটা রাস্তা থেকে রাস্তার পাশের ঘাসগুলোর কথা ভাবুন। এবার কেমন হবে যদি প্রতিটা বস্তুই স্থানচ্যুত হয়ে একদম মৃত জোম্বির মতো নাড়াচাড়া করতে থাকে? ঠিক সে ব্যাপারটাই ঘটছে। আর কোনোভাবেই একে মস্তিষ্কের ভুল বলে চালিয়ে দেয়া যাচ্ছে না। ল্যাম্পপোস্টটা জায়গা থেকে মাটি ফুঁড়ে উঠে ল্যাংচে ল্যাংচে এগোচ্ছে। ভাগ্য ভালো তারগুলো এখনো আটকানো আছে। গাছগুলো সব মাটি ছেড়ে উঠে ঘোরাফেরা করছে। যেন খুঁজছে কিছু একটা। রাস্তার পাশের বেঞ্চটা ত্যাড়াব্যাকা হয়ে আপনাতেই এগোচ্ছে। আমি সহ্য করতে পারলাম না। জানালা ঠাস করে বন্ধ করে দিলাম। বিছানায় বসে হাপাচ্ছি রীতিমতো। কী ঘটছে এসব!

খানিক ধাতস্থ হতেই কী মনে হলো, চট করে তাকালাম আমার রুমের মাঝে। যা ভেবেছি তা-ই। প্রতিটি বস্তু একদম আমার দিকে মুখ করে আছে। যেন মনে হচ্ছে তাকিয়ে আছে একদম আমার দিকে। এরপরই ভয়ানক ব্যাপারটা শুরু হলো। হুট করেই লাইটটা নিভে গিয়ে অন্ধকার হয়ে গেলো ঘরটা। শুধু বাইরের ল্যাম্পপোস্টের নড়তে থাকা আলোটা জানালার কাচ ভেদ করে ঢুকে পড়ছে। ভেতরের প্রতিটা বস্তু আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে শুরু করলো আমার দিকে। বিছানার পাশে রাখা কাঁথাটা পেঁচিয়ে রূপ নিয়েছে সাপের মতো। এঁকেবেকে ধীরেধীরে এগিয়ে আসছে। ব্যাগটাও আবার আগের মতো উঠে দাঁড়িয়েছে। এদের কোনো চোখ নেই, কিন্তু আমি অনুভব করতে পারছি সবকিছুর তীব্র দৃষ্টি ঠিক আমার দিকে। মনে হচ্ছে যেন অস্তিত্বহীন চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে। বইগুলো টপাটপ শেলফ থেকে পড়ছে একটা দুটো করে। আমি বিছানার একদম কোনায় চলে গেলাম। তীব্র ভয়ের রেশ বয়ে যাচ্ছে সারা শরীরে। চিৎকার দেবার মতো মানসিক শক্তিটাও নেই। বিস্ফারিত চোখে দেখছি মৃত্যুর মতো ধীরপায়ে এগিয়ে আসা সহস্র বিভীষিকা।

***

রিফানের মাথায় ঠাস করে একটা চাটি মেরে বসলো সাবরিনা। এই মেয়ে বড়ো ভয়াবহ প্রকৃতির। আমাদের ক্লাসে ছেলেরাও ওকে ঘাঁটানোর সাহস করে না। চাটি মেরে চোখ পাকিয়ে বলে উঠলো, “গুল মারার আর জায়গা পাস না! শুধু তো ব্যাগটা পালটেছিস দেখছি। এতে এত আজগুবি গল্প ফাদতে বলেনি তোকে কেউ।”

আমি মুখ টিপে হেসে উঠলাম। রিফান রেগে উঠলো। “একটা বর্ণও মিথ্যা না। বিশ্বাস না হলে তুই রাতের বেলায় আমাদের বাড়িতে এসে দেখিস। আমার কথা কেউ বিশ্বাস করে না কিন্তু তোকে দেখাবো আমি।”

“আবার! একটা চটকানা দেবো এবার!”

আমি মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করলাম এবার। “আচ্ছা থাম। গল্পটা তো মজাই লাগছিলো। কিন্তু ভয়ে বিছানায় হিসু করে দিয়েছিস এরকম কিছু শেষে থাকলে আরো জমে যেত।”

সাবরিনা আর আমি একসাথে হেসে উঠলাম। রিফান চুপ করে দেখলো আমাদেরকে। এরপর ধীরস্বরে বলতে শুরু করলো৷ “তোরা হাসতে পারিস। কিন্তু আমি জানি সামনে কী এক দুঃসময়। শোন, ওপরে যা দেখা যায় তা-ই সত্যি নয়। তার আড়ালে আরো বহু কাহিনি থাকে।”

আমি হালকা স্বরে বললাম, “বহু কিছু মানে? তোর ব্যাগের কি হাতপা গজাবে সামনে?”

রিফান এবার বিরক্ত হলো না। ভাবলেশহীন স্বরে বললো, “আমি জানি এখানে অনেক কিছু ঘটছে। মহাপ্রাণ এমনি এমনি জেগে উঠছে না। বিশাল এক ষড়যন্ত্রের জাল ছড়িয়ে আছে। এর সুতা কার হাতে জানি না।”

“তাই নাকি? কেন এমন মনে হলো?” হাসি চেপে সাবরিনা জিজ্ঞেস করলো।

রিফান একটা নিঃশ্বাস ফেললো। “তোরা ইচ্ছামতো হাসতে পারিস। কিন্তু সামনে বড়ো বিপদ। আমি টের পাচ্ছি অনেক কিছু ঘটছে। এমনিতে সব স্বাভাবিক। কিন্তু রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, তখন জীবন্ত হয়ে যায় সব। তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের চারপাশের প্রতিটি জড়বস্তু আমাদেরকে পাকড়াও করবে। আমি সেদিনের পর প্রতিদিনই কিছু না কিছু দেখেছি। আমার ধারণা আমাকে কেউ সতর্ক করছে। সবাইকে জানানোর জন্য।”

“তাই নাকি?”

রিফান পাত্তা দিলো না। “আমার ধারণা আমাদের জগলুল সাহেবও এর সাথে জড়িত। তাকে একদিন দেখলাম বাড়ির সামনের ল্যাম্পপোস্টের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। তাকে যতবারই বলেছি আমি কীসব দেখছি, ততবারই শুধু মুচকি হেসেছে। কিছু একটা ঘটছে। আমি জানি বিশাল এক ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হচ্ছে সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে।”

আমি হাই তুলে বললাম। উঠতে উঠতে বললাম, “হ্যাঁ একদম। আশা করছি খুব শিঘ্রই ইলুমিনাতি, বোহেমিয়াম গ্রোভ সব নিশ্চিতভাবে যোগ দেবে এসব কন্সপিরেসিতে।”

রিফান আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সাবরিনাও উঠে অন্যদিকে চলে গেলো। ইদানীং রিফান ভালোই আজগুবি কথাবার্তা বলছে। শুধু আমাদেরকে না, খেয়াল করেছি ক্লাসের সবাইকেই ফিসফিসিয়ে এসব গালগল্প করছে। এখনো উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছায়নি ব্যাপারটা। আশা করি সেরকম কিছু হবেও না।

আমাদের স্কুলের পেছনে বিশাল একটা পুকুর আছে। তার সাথেই পরিত্যক্ত ভবনটা। ব্রিটিশ আমলে বানানো ছিলো এটি। পরবর্তীতে নতুন করে অন্য অংশগুলো বানানো হয়েছে।

আমি হেঁটে গেলাম পরিত্যক্ত অংশটার দিকে। একটা দেয়ালে লুকোনো সুইচ চাপ দিতেই একটা প্রবেশপথ খুলে গেলো। ভেতরে ঢুকে গেলাম। প্রাচীন দালানগুলোতে নানান বিস্ময়কর ব্যাপার থাকে। ভেতরে গোলকধাঁধার মতো পথ পেরিয়ে একটা করিডর পাওয়া গেলো। মৃদু ফিসফাস শুনতে পাচ্ছি। শরীরে চনমনে ভাব চলে আসলো। ঠিক তখনই দেখলাম একটা স্কুলব্যাগ মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে ফিসফাস করছে। যেন কোনো মন্ত্র জপছে। অবাক হলাম না। সেটি পেরিয়ে বড়ো হলঘরটায় ঢুকে গেলাম। প্রার্থনা শুরু হয়ে গেছে। মানুষ ছাড়াও ইট, পাথর, কাপড় সহ নানান বস্তু মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে মন্ত্র জপছে। পেছন দিকে একটা ফ্রিজও আছে দেখলাম। ডালা খুলছে আর বন্ধ করছে। মহাপ্রাণ জেগে উঠছে আস্তে আস্তে। আমি গিয়ে জগলুল সাহেবের পাশে দাঁড়ালাম। সাবরিনাকেও দেখলাম যোগ দিয়েছে। সে অন্য কোনো প্রবেশপথ দিয়ে এসেছে।

জগলুল সাহেব ফিসফিস করে বললো, “খুব ভালো কাজ করছে জিনিসটা।”

“হ্যাঁ তা তো দেখতেই পাচ্ছি। রিফানকে দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট না করলেও হতো বোধহয়।”

“উহু হতো না। সবকিছুর পেছনেই একটা কারণ আছে। চোখে যা দেখা যায় তা-ই নয়, আরো বিশাল কিছু ঘটনা থাকে পেছনে সবসময়ই।”

বলেই সে চোখ টিপলো। সমবেত মৃদু ফিসফিসানির সুর ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। শব্দের মাত্রা আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে পরবাস্তবতার দিকে। এই জগত শুধু জগতের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। মহাপ্রাণের সাথে জুড়ে গিয়ে যোগ হয়ে গেছে পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সামনে। আমরা ছাড়া সব মানুষ খুব শিঘ্রই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। যদি আমাদেরকে এখন আদৌ মানুষ বলা যায় আরকি।

আমি চোখ তুলে তাকালাম। দেখতে পাচ্ছি আমার কাহিনিটা আপনি পড়ছেন। দেখতে পাচ্ছেন আমাকে? কল্পনা করুন। কল্পনা করুন, এবার নিশ্চয়ই স্পষ্ট দেখছেন আমি কতটা তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ঠিক আপনার দিকে। চারপাশে মোহময়ী সুর এক ইন্দ্রজালের সৃষ্টি করছে। এর মাঝেই আপনাকে সতর্ক করছি, সাবধানে থাকবেন। প্রতিটি বস্তু জীবন্ত। খুব শিঘ্রই আপনি নিশ্চিহ্ন হবেন, কোনো এক জড়বস্তু দ্বারা। মহাপ্রাণ গ্রাস করে নেবে আপনাকে। শুনতে পাচ্ছেন? আমার মুখে ফুটে ওঠা হাসিটা আপনার জন্য।

 

সমাপ্ত

 

 

লেখক: সালেহ আহমেদ মুবিন। বাংলাদেশের ফ্যান্টাসি সাহিত্যে পরিচিত একটি নাম। পাশাপাশি সম্পাদনা এবং প্রুফরিডিং-এ নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। ছোটগল্প, অনুবাদ, আর লেখনীতে মুগ্ধ করে চলেছেন বাংলাদেশের থ্রিলার আর ফ্যান্টাসি পাঠকদের।

ঐশ্বর্য প্রকাশের প্রকাশিত যে বইগুলোতে সালেহ আহমেদ মুবিন জড়িত ছিলেন।

দি লর্ড অফ দ্য রিংস: দি ফেলোশিপ অফ দ্য রিং (বুক ১)

১০০০ গজ

লিজিয়ন

দ্য গিভার

0
    0
    Your Cart
    Your cart is emptyReturn to Shop