বই: দ্য গিভার
লেখক: লোইস লোওরি
অনুবাদ: ফাহাদ আল আব্দুল্লাহ
সম্পাদনা: মহিউল ইসলাম মিঠু ও সালেহ আহমেদ মুবিন
প্রচ্ছদ: লর্ড জুলিয়ান
প্রুফরিডিং: বীক্ষণ সম্পাদনা সংস্থা
ধরণ: সায়েন্স ফিকশন, ডিস্টোপিয়ান
মূল্য: ৩২০ টাকা
প্রকাশনী: ঐশ্বর্য প্রকাশ
প্রথম অধ্যায়
ডিসেম্বর এগিয়ে আসছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে জোনাসের মনে বাসা বাঁধছে ভয়। উহুঁ। ভয় বললে ভুল হবে, মনে মনে ভাবে জোনাস। ভয় আসলে মনের অতল থেকে উঁকি দেওয়া ফণা তোলা সাপের মতো, বাজে কিছু ঘটার আশঙ্কায় মন অসুস্থ লাগে অষ্টপ্রহর এটাকে ঠিক ভয় বলা যায় না।
ভয় জোনাস পেয়েছিল এক বছর আগে। সেবার কম্যুনিটির ওপর দিয়ে পর পর দুবার উড়ে গিয়েছিল একটা অচেনা উড়োজাহাজ। দুবারই ওটাকে দেখেছিল সে। বিদুৎবেগে আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ভেদ করে বেরিয়ে গেল প্লেনটা। খানিক পরে আবার একইরকম দ্রুতবেগে উলটো পথে উড়ে গেল ওটা। চোখ পিটপিট করে সেই যাওয়া-আসা দেখেছিল জোনাস।
ভয়ের সাথে সাথে তার মনে বেশ আগ্রহও জেগেছিল। কম্যুনিটির এত কাছে উড়োজাহাজ চালানো নিষেধ। পাইলটরা বেশ ভালোভাবে মেনে চলেন নিয়মটা। ফলে, এর আগে অত কাছে থেকে কখনো উড়ন্ত কোনো যান দেখেনি ও। মাঝেমধ্যে যখন কার্গো প্লেন আসতো, ছোটো ছেলেমেয়েরা সাইকেলে চড়ে নদীর পাড়ে চলে যেত। নদীর ওপারে বসে থাকতো বিশাল কার্গো বিমান। ওরা সাগ্রহে মাল-সামানার ওঠা নামা দেখতো। এরপরে কার্গো বিমান উড়ে যেত পশ্চিমে। তবে সেটাও কম্যুনিটি থেকে বেশ তফাতে।
এক বছর আগের সেই বিমানটা বেশ আলাদা। পেটমোটা, বোঁচা কোনো কার্গো বিমান ছিল না ওটা, ছিল চোখা নাকের একটা জেট, ওতে স্রেফ একজন পাইলটেরই জায়গা হয়। উৎকণ্ঠায় আশেপাশে তাকায় জোনাস। ছোটোদের সাথে বড়োরাও কাজ ফেলে আকাশে জেট বিমানের ওড়াউড়ি দেখছিল। সবার মনে সংশয়। আকাশে হুট করে জেট বিমানের আনাগোনা হলে এমন সংশয় স্বাভাবিক। পুরো ঘটনার ব্যাখ্যা জানার জন্য উৎকণ্ঠিত অপেক্ষা সবার।
ঠিক সেই মুহূর্তে জেগে ঊঠেছিল স্পিকার। একটা খসখসে কণ্ঠ সবাইকে কাছের কোনো দালানে আশ্রয় নেয়ার নির্দেশনা দেয়। পরবর্তী আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত সেখানেই থেকে যাবার নির্দেশও দেয় কণ্ঠটা।
“যার যার সাইকেল যেখানে আছে সেখানেই ফেলে যান,” বলেছিল স্পিকারের কণ্ঠ।
সাথে সাথে বাধ্য ছেলের মতো সাইকেলটা ওদের বাড়ির পেছনের রাস্তার পাশে ফেলে দেয় জোনাস। দৌড়ে ভেতরে গিয়ে ওখানেই বসে থাকে, একাকী। ওর মা-বাবা দুজনেই কাজে গেছেন, ছোটো বোন লিলি ছিল চাইল্ড কেয়ার সেন্টারে। স্কুলের পরের সময়টা সে ওখানেই কাটায়।
জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখে সব রাস্তা জনশূন্য। এই সময়ে সাধারণত সাফসুতরো করার লোকজন, মালি, খাবার সরবরাহকর্মীদের ভিড়ে গিজগিজ করে গোটা এলাকা। তখন জোনাস শুধু এলোমেলোভাবে ফেলে যাওয়া বাইসাইকেল দেখতে পাচ্ছিল। কোনোটা কাত হয়ে পড়ে আছে, কোনোটা রাস্তার পাশে কোনো অবলম্বনের ওপর ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো, একটার চাকা তো সোজা আকাশের দিকে মুখ ব্যাদান করছে, তখনো অল্প-অল্প ঘুরছিল।
সেই মুহূর্তে ভয় পেয়েছিল জোনাস। কম্যুনিটি যেন নিশ্চুপে কিছু একটা ঘটার অপেক্ষায়। এই চিন্তাটাই ওকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছিল। অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠছিল শরীর।
তবে আশঙ্কা পুরোটাই অমূলক। মিনিটখানেকের মাথায় আবার জ্যান্ত হয়ে উঠেছিল স্পিকার। ভেসে আসা কণ্ঠটাকে অনেকটাই ভারমুক্ত মনে হচ্ছিল। ট্রেনিং-এ থাকা এক পাইলট নেভিগেশনে ভুল করেছে। কেউ বুঝে ওঠার আগেই সে ফিরে যেতে চাইছিল।
“একটি ব্যাপার নিশ্চিত, আমরা এই পাইলটকে ছেড়ে দেবো।” বলে স্পিকারের কণ্ঠ। শেষ কথাটায় মিশে আছে শ্লেষ, যেন স্পিকারে কথা বলা লোকটা বিষয়টা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিল। জোনাসের ঠোঁটের কোণে একটু বিষাদি হাসি খেলে গিয়েছিল। কোনো নাগরিকের জন্য ‘ছেড়ে দেওয়া’ একেবারে চূড়ান্ত ধরনের দণ্ড। ব্যর্থতার পরাকাষ্ঠা।
খেলাচ্ছলেও বাচ্চারা ‘ছেড়ে দেওয়া’ শব্দটা ব্যবহার করে না। কোনো সহপাঠী ক্যাচ ছাড়লে, দৌড়ে হোঁচট খেয়ে মাটি ছেড়ে শূন্যে ঘুরে এলেও তা নিয়ে কেউ মজা করে না। হালকাভাবে এই শব্দ কেউ ব্যবহার করলেও তাকে বকা খেতে হয়। জোনাস একবার এরকম একটা কাজ করেছিল। ওর বন্ধু অ্যাশারের একটা ভুলের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ হেরে বসেছিল ওরা। বিরক্ত হয়ে জোনাস বলে ফেলেছিল, “অনেক হয়েছে অ্যাশার! তোমাকে ছেড়ে দিলাম!” এরপর জোনাসকে একপাশে ডেকে নিয়ে কড়া একটা আলোচনা করেছিলেন কোচ। লজ্জায় আর অপরাধবোধে মাথা নিচু হয়ে গেছিল ওর। খেলা শেষে অ্যাশারের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হয়েছিল জোনাসকে।
নদীর ধার বরাবর সাইকেল চালিয়ে আসতে আসতে ভয়ের অনুভূতিটা নিয়ে ভাবছে সে। তার মনে পড়ে যাচ্ছে জেট বিমান দেখতে পাবার দিনের গা-গোলানো চাপা ভয়টার কথা। তবে এখন যে সে ঠিক একদম তেমনটা অনুভব করছে তা না। ওদিকে ডিসেম্বরও এসে যাচ্ছে। আর এই সময়টায় তার অনুভূতিটা ঠিক কেমন তা বোঝানোর জন্য ওকে সঠিক শব্দটা খুঁজতে বেগ পেতে হচ্ছে রীতিমতো।
কথা বলার সময় বেশ সতর্ক জোনাস। ওর বন্ধু অ্যাশার খুব দ্রুত সব কথা একেবারে বলতে চায়। এতে যা হয়, শব্দ, বাক্য সব জড়িয়ে ফেলে। ওর কথা বেশিরভাগ হয় অবোধ্য নয়তো হাস্যকর।
একদিনের কথা মনে হতে দাঁত বের করে হাসে জোনাস। বরাবরের মতোই সেদিন ক্লাসে দেরিতে এসেছিল অ্যাশার। সকালের জাতীয় সংগীত গাইবার মাঝখানে হাঁপাতে হাঁপাতে ক্লাসরুমে ঢুকেছিল। দেশপ্রেমের গান শেষে যখন সবাই বসেছে, তখনো অ্যাশার ঠায় দাঁড়িয়ে। সবার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে তার, সেটাই নিয়ম।
“আমার লার্নিং-কম্যুনিটিকে বিরক্ত করবার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।” ক্ষমা চাইবার জন্য এই লাইনটাই ওদের শেখানো হয়। সেটাই দ্রুত মুখস্ত আউড়ে যায় অ্যাশার। প্রশিক্ষক আর ক্লাসের বাকি সবাই ওর দেরির কারণ জানার জন্য নিশ্চুপ বসেছিল। ছাত্র-ছাত্রী সবার মুখে ঠোঁট চাপা হাসি। অ্যাশারের চর্বিত-চর্বণ অযুহাতও ওদের মুখস্ত।
“আমি একেবারে সময়মতোই ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম, কিন্তু হ্যাচারির পাশ দিয়ে আসার সময় দেখি ওখানে একজন কর্মী স্যামন মাছ কাটছে। কিছুক্ষণের জন্য আমি বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছিলাম বোধহয়।”
“আমি আমার সহপাঠীদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী,” অ্যাশার কথা শেষ করে। কুঁচকে যাওয়া লম্বা টিউনিকটা সোজা করে বসে পড়ে সে।
“আমরা তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম, অ্যাশার।” সমস্বরে বলেছিল ক্লাসের সবাই। এভাবে সমম্বরে ক্ষমা করে দেয়াটাও নিয়মের মধ্যেই পড়ে। ক্লাসের অনেকেই ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকাবার চেষ্টা করছে।
“আমি তোমাকে ক্ষমা করছি, অ্যাশার।” বলেন প্রশিক্ষক। তিনিও হাসছিলেন। “আর তোমাকে ধন্যবাদ, তুমি আমাদেরকে আবারও ভাষার ব্যবহারে নতুন কিছু শেখার সুযোগ দিলে। স্যামন মাছের কাটা দেখে যেটা হয়, ওটাকে বিক্ষিপ্ত বলে না। বিক্ষিপ্ত বেশ শক্তিশালী একটা শব্দ।” উনি ঘুরে বোর্ডে লিখেছিলেন ‘বিক্ষিপ্ত’। তার পাশে লিখেছিলেন ‘বিভ্রান্ত’।
জোনাস বাড়ির কাছে পৌঁছে গেছে প্রায়। অ্যাশারের ভুল্ভাল শব্দ বলা, দেরি করে আসা, ক্লাসের নানান ঘটনা, এসব মনে করে নিজের মনেই হাসছিল। বাড়ির পাশে সাইকেলটা রাখার সময়ও নিজের মনের অবস্থা ব্যাখ্যার জন্য একটা জুতসই একটা বিশেষণ হাতড়ে বেড়াচ্ছিল মস্তিষ্কের আনাচে-কানাচে। সে বুঝতে পারছে ‘ভয়’ শব্দটা দিয়ে তার মনের অবস্থা ব্যাখ্যা করাটা পুরোপুরি ঠিক হচ্ছে না। ডিসেম্বর দোরগোড়ায়, এই মুহূর্তে ভয় খুব শক্তিশালী এক বিশেষণ বটে।
এবারের ডিসেম্বর অন্যান্য ডিসেম্বরের থেকে বেশ আলাদা। এর জন্য বহুদিন অপেক্ষা করেছে জোনাস। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এখন ওর কাঁধের ওপর শ্বাস ছাড়ছে। তবে সেটা নিয়ে ওর মনে কোনো ভয় নেই… সে জায়গার দখল নিয়েছে চাপা উত্তেজনা। উতলা হয়ে আছে জোনাস এই ডিসেম্বরের জন্য। সব এগারো বছর বয়সি ছেলেমেয়েরাই ডিসেম্বরের জন্য উতলা থাকে। কারণ জীবনের এগারোতম ডিসেম্বরটা তাদের জীবন বদলে দেয়।
কী হতে পারে, এই চিন্তায় খানিকটা দুশ্চিন্তার কম্পন খেলে যায় ওর দেহে। ভবিষ্যতের চিন্তায় শঙ্কিত ও।
আরে হ্যাঁ, শঙ্কিত! এটাই তো সেই শব্দটা। ঠিক এই শব্দটাই এতক্ষণ মস্তিষ্কে ঝড় তুলে খুঁজে যাচ্ছিল সে। এটিই তার মনের অনুভূতিটাকে উপস্থাপন করতে পারছে ঠিকঠাকভাবে। এতক্ষণে আসল শব্দটা পেয়েছে জোনাস। সে আসলে শঙ্কিত।
“আজকে প্রথমে কে বলবে মনের কথা?” জোর গলায় বলেন জোনাসের বাবা। ওদের রাতের খাবার শেষ হয়েছে কেবলই। টেবিলে বসে আসে পুরো পরিবার।
এটা ওদের পরিবারের একটা প্রথা। প্রতিদিন রাতের খাবার শেষে ওরা নিজেদের মনের কথা বলে। কে আগে বলবে, তা নিয়ে জোনাস আর ও বোন লিলির তর্কাতর্কিও বাঁধে কখনো-সখনো। সবাইকে যার যার মনের কথা বলতে হয়। এমনকি ওদের মা-বাবাকেও। প্রতিদিন সান্ধ্যভোজনের পর নিয়ম করে মনের কথা বলতে হবে সবাইকেই। ওদের মা-বাবা অবশ্য আগে-পরে বলা নিয়ে বিবাদে জড়ান না। বড়ো মানুষগুলো যেমন হয় আরকি।
আজকে জোনাসেরও তর্কে অরুচি। ওর মনের ভেতর বিভিন্ন অনুভূতির কঠিন লড়াই চলছে। মনের সব কথা উগড়ে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে, আবার একইসাথে নিজের এসব জটিল অনুভূতিগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতেও ইচ্ছে করছে না। যদিও জানে, ওর মা-বাবা সব শুনলে কোনো একটা উপায় বাতলে দিতে পারবে।
“আজকে তাহলে লিলি প্রথমে।” বাবার কথার উত্তরে শেষমেশ বললো জোনাস। ওর সাত বছরের বোন লিলি চেয়ারে বসে ছটফট করছিল। ছোটো মানুষ, ধৈর্যের বেজায় অভাব।
“বিকেলে খুব রাগ হচ্ছিল আমার।” বলতে শুরু করল লিলি। “আজকে আমরা আমাদের চাইল্ডকেয়ার গ্রুপের সবাই মিলে খেলছিলাম। সাত বছর বয়সিদের আরেকটা গ্রুপ এসেছিল আমাদের এখানে ঘুরতে। খেলার সময় ওরাও আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু খেলার নিয়ম বারবার ভাঙছিলো ওরা। ওদের মধ্যে একজন – একটা ছেলে; নাম জানি না- বারবার স্লিপারের লাইনের সামনে চলে যাচ্ছিল। আমরা সবাই লাইন ধরে অপেক্ষা করছি আর ও লাইন ভেঙে সামনে যাচ্ছে। ওর ওপর খুব রাগ উঠেছিল আমার। আমি হাত মুঠো করেছিলাম, এই যে এভাবে।” মুঠো পাকিয়ে সবাইকে দেখায় লিলি। বাকি সবাই ওর ছোট্ট মুষ্ঠির প্রতিবাদী ভঙ্গি দেখে মুচকি হাসল।
“ওরা বেড়াতে এসে নিয়ম ভাঙলো কেন, লিলি? তোমার কী মনে হয়?” মা জিজ্ঞেস করলেন।
কিছুক্ষণ ভাবে লিলি, তারপরে মাথা নাড়ে। “জানি না। কেমন যেন করছিল… কেমন যেন…”
“পশুর মতো?” যোগ করে জোনাস। হাসে।
“হ্যা, একদম তা-ই, পশুর মতো!” বলে লিলি। সে-ও হাসে। ভাইবোন দুজনেরই পশুর মতো ব্যাপারটার মানে অজানা। ওরা শুধু জানে অশিক্ষিত বা বেখাপ্পা লোকজনকে ঐ নামে ডাকা হয়। এমন কেউ, যে সমাজে মানিয়ে চলতে অপারগ।
“কোথা থেকে এসেছিল গ্রুপটা?” বাবা বলেন।
ভুরু কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করে লিলি। “স্বাগত বক্তব্য দেবার সময় আমাদের গ্রুপ লিডার বলেছিল জায়গার নামটা। এখন ভুলে গিয়েছি। মন দিয়ে শুনিনি আসলে। অন্য কোনো একটা কম্যুনিটি থেকে এসেছিল। এসে খুব দেরিও করেনি, তাড়াতাড়ি চলেও গিয়েছিল। দুপুরের খাবার বাসেই খেল দেখলাম।”
মাথা ঝাঁকান মা। “ওদের ওখানে কী নিয়ম কানুন আলাদা? এজন্য ওরা হয়তো এখানকার খেলার আদব-কায়দা জানেই না?”
কাঁধ নাড়ায় লিলি। “হতে পারে।”
“তুমি অন্য কম্যুনিটি ঘুরে এসেছ না?” বলে জোনাস, “আমার গ্রুপ বেশ কয়েকবার অন্য কম্যুনিটি দেখে এসেছে।”
আবার মাথা ঝোঁকায় লিলি। “গত বছর, ছবছর বয়সে। তখন অন্য কম্যুনিটিতে গিয়েছিলাম, সারাদিন ওদের ছ’বছরের গ্রুপের সাথে ছিলাম।”
“তখন তোমার কেমন লেগেছিল?”
ভুরু কোঁচকায় লিলি। “আজব লেগেছিল। ওদের ওখানে ব্যাপারগুলো কেমন যেন অন্যরকম। এমন সব জিনিস শিখছিল, আমাদের গ্রুপ সেগুলো শুরুই করেনি। নিজেদের খুব বোকা-বোকা লাগছিল।”
আগ্রহভরে শুনছিলেন বাবা। “লিলি, আমার কী মনে হয় জানো? যে ছেলেটা আজকে এখানের নিয়ম ভেঙেছে, ওরও হয়তো নিজেকে বোকা বোকা মনে হচ্ছিল। নতুন জায়গা, আলাদা নিয়ম, যেগুলো ও কিছুই জানে না, তাই না?”
কিছুক্ষণ ভাবল লিলি। অবশেষে বলল, “হুম। হতে পারে।”
জোনাস বলল, “ছেলেটার জন্য আমার এখন খারাপই লাগছে, যদিও ওকে আমি চিনিও না। কারণ নতুন একটা জায়গায় আসলে সবারই একটু বোকা বোকা লাগে।”
“কী লিলি, এখনও রাগ হচ্ছে?” বাবা বললেন।
“মনে হয় না,” বলে লিলি। “আমারও এখন ছেলেটার জন্য একটু খারাপই লাগছে। খেলার সময় ঘুসি দেখিয়েছিলাম। কাজটা ঠিক হয়নি।” একটু দ্বিধান্বিত হাসি হাসে লিলি।
লিলির দিকে তাকিয়ে পালটা হাসে জোনাস। লিলির মনের খেয়াল সবসময়ই সোজাসাপ্টা। সরল, সহজেই সমাধান করা যায়। অবশ্য সাত বছর বয়সে জোনাসের নিজের সমস্যাও এমনই ছিল। অন্তত তার তা-ই মনে হয়।
এরপরে বাবা কথা শুরু করলেন। ভদ্রভাবে শুনছিল জোনাস, কিন্তু তার মন পড়ে ছিল অন্য কোথাও। একটা সদ্যোজাত শিশু অসুস্থ। জোনাসের বাবার কাজ ছোটো শিশুদের যত্ন নেওয়া। উনার পদবি নারচারার। তিনি আর বাকিসব নারচারার মিলে নতুন জন্ম নেওয়া সব বাচ্চার যত্ন নেন। ওদের যা প্রয়োজন, দেহের বৃদ্ধি কিংবা মানসিক শান্তি, সব দেখাশোনার দায়িত্ব তাদের ওপর। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সবই জানে জোনাস, তবুও একাজ ওকে তেমন একটা টানে না।
“ছেলে না মেয়ে?”
“ছেলে,” বাবা বলেন, “মিষ্টি একটা ছেলে। দেখতে শুনতেও বেশ। কিন্তু যত দ্রুত বাড়া দরকার তত দ্রুত বাড়ছে না। আজকাল ঠিকমতো ঘুমাচ্ছেও না। ওকে নিয়ে এক্সট্রা কেয়ার সেকশনে রেখেছি আমরা। আরও বেশি যত্ন নিচ্ছি। কিন্তু কমিটি ওকে ‘ছেড়ে দেবার’ কথা ভাবছে।”
“আহ্হা!” বলেন মা। তাঁর কণ্ঠে সমবেদনা। “বুঝতে পারছি তোমার কতটা খারাপ লাগছে।”
জোনাস আর লিলিও সমবেদনায় মাথা ঝোঁকায়। নতুন শিশুদের ছেড়ে দেওয়া সবসময়ই কষ্টের। কম্যুনিটির ভেতরের জীবন উপভোগ করার কোনো সময়ই তারা পেলো না। অথচ তাদের নিজেদের কোনো দোষ থাকে না এখানে। এই সমাজের নিয়ম বড়ো কঠিন।
শুধু দুই ক্ষেত্রে ‘ছেড়ে দেওয়া’ উদযাপনের ব্যাপার। বৃদ্ধ ব্যক্তিদের যেদিন ‘ছেড়ে দেওয়া’ হয়, সেদিনটায় ওঁদের ঘটনাবহুল জীবন উদযাপন করে সবাই। ছোটো বাচ্চাদের ছাড়ার সময় সবার মনে একটাই চিন্তা থাকে, আর কী কী করলে এই অঘটনটা ঠেকানো যেত? জোনাসের বাবার মতো নারচারারদের জন্য এই দিনটা আরও বেশি কষ্টের। তাঁদের কাছে ব্যাপারটা বিশাল পরাজয়। তবে, এরকম ঘটনা বিরল।
“যা-ই হোক,” বাবা বলেন, “আমি যতদূর পারি চেষ্টা করব। তোমাদের অনুমতি পেলে রাতে ওকে একবার আমাদের এখানে নিয়ে আসতে চাই। জানোই তো নাইট শিফটের নারচারাররা কেমন যেন। আমার মনে হচ্ছে ছেলেটার আরও বেশি যত্ন দরকার।”
“অবশ্যই!” বলেন মা। জোনাস আর লিলিও সায় দেয়। আগেও ওদের বাবা নাইট শিফট নিয়ে রাগ ঝেড়েছেন। উনার চোখে কাজটা অসন্মানের। যাদের দিনের বেলার নারচার ডিউটিতে মনোযোগ বা আগ্রহের অভাব, তাদের স্থান হয় নাইট শিফটে। নাইট শিফটের বেশিরভাগ ক্রু-কে জীবনসঙ্গী গ্রহণের অনুমতিও দেওয়া হয় না। কোনো কারণে এই ক্রু-এর লোকেদের কারো সাথে সুসম্পর্ক রাখার ক্ষমতা নেই। অথচ যে-কোনো ফ্যামিলি ইউনিটের জন্য এই দক্ষতা যারপরনাই জরুরি।
“ওকে আমরা রেখেও দিতে পারি।” বলে লিলি। মিষ্টি করে হাসছে এখন, নিষ্পাপ কপটতা ওর চেহারায়। এই অভিনয় জোনাসের অতি পরিচিত। পুরো পরিবার ওই মিষ্টি মুখের পেছনের উদ্দেশ্য খুব ভালোভাবে জানে।
মা হাসিমুখে তাকালেন ওর দিকে। মনে করিয়ে দেবার ভঙ্গিতে বলেন, “লিলি, নিয়ম তো সব জানোই।”
দুটো বাচ্চা – একটি ছেলে, একটি মেয়ে – সব ফ্যামিলি ইউনিটের জন্য একই বরাদ্দ। নিয়মের তালিকায় স্পষ্টাক্ষরে লেখা।
খিলখিল করে হাসে লিলি। “ভাবলাম, এই একবার যদি আইন ভাঙি, তাহলে কী হবে!”
সবার শেষে ওদের মা নিজের মনের কথা বলেন। তিনি বিচারবিভাগে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। আজকে এক পুরানো পাপীকে আনা হয়েছিল তার সামনে। এর আগেও নিয়ম ভেঙেছে সে। উনি ভেবেছিলেন তাকে ভালোমতো সাজা দেওয়া হয়েছে। এরপরে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে তার চাকরি আর ফ্যামিলি ইউনিটতে। কিন্তু দ্বিতীয়বার আবার নিয়ম ভঙ্গের জন্যই তাকে আনা হয়েছে দেখে মা-এর ভেতর হতাশা আর ক্রোধ উথলে উঠেছিল। খানিকটা অপরাধবোধও জমা হয়েছিল অবশ্য। লোকটার কোনো উপকারে আসতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।
“আমারও লোকটার জন্য ভয়ও হচ্ছিলো,” স্বীকার করলেন মা। “কম্যুনিটিতে তৃতীয় সুযোগ বলে কিছু নেই, সেটা তো জানোই। এরপরে আবার আইন ভাঙলে ওকে স্রেফ ‘ছেড়ে দেবে’।” জোনাসের শরীর শিউরে ওঠে। ও জানে এই ‘ছেড়ে দেবার’ ব্যাপারটা। ওর এগার বছর বয়সিদের গ্রুপের একজনের বাবাকে বছরখানেক আগে ‘ছেড়ে দিয়েছে’ কম্যুনিটি। গ্রুপের কেউ সাধারণত ভুলেও এই ব্যাপারটার উল্লেখ করে না। কারণ কম্যুনিটি থেকে বিদায় দেওয়াটা লজ্জা আর গ্লানির চূড়ান্ত।
লিলি উঠে ওর মার কাছে যায়। তার বাহুতে হাত বোলাতে থাকে।
চেয়ারে বসেই মায়ের হাত ধরেন বাবা। অন্য হাতটা ধরে জোনাস।
এক এক করে পরিবারের সবাই উনাকে সান্ত্বনা দেয়। মা-এর মুখে হাসি ফুটতে দেরি হয় না। সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ফিসফিস করেন যে এখন তার মন এখন শান্ত।
মনের কথা বলা চলতে থাকে। “জোনাস?” বাবা বলেন। “আজ রাতে তোমার পালা সব শেষে।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জোনাস। যেন পালাতে পারলে বাঁচে ও। কোথাও লুকিয়ে পড়তে পারলে দারুণ হতো। অবশ্য সেটা হবে পরিবারের নিয়ম ভাঙা। কিন্তু নিয়ম মানতেই হবে।
“আমি কেমন যেন শঙ্কিত বোধ করছি।” অবশেষে বলতে শুরু করল জোনাস। মনের অবস্থা বোঝাবার জন্য ঠিকঠাক শব্দটা খুঁজে পাওয়ায় মনে মনে খুশি ও।
“কেন বাবা? দুশ্চিন্তা কেন?” ওর বাবার চোখে উদ্বেগ।
“আসলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।” জোনাস বলে, “বড়োরা সবাই এই ঘটনা দেখেছে। তুমি দেখেছ, মা-ও দেখেছে। কিন্তু অনুষ্ঠানটার ব্যাপারে আমার কেন যেন খুব চিন্তা হচ্ছে। আর ডিসেম্বরও প্রায় চলে এসেছে।”
জোনাসের দিকে ফেরে লিলি, বড়োবড়ো চোখে ভাইকে দেখছে সে। “ওহ! বারো বছর বয়সিদের জন্য সেই অনুষ্ঠানটার কথা বলছ!” ওর চোখে খানিকটা ভয়, খানিকটা শ্রদ্ধা। ছোটো ছোটো বাচ্চারাও – লিলির বয়সি কিংবা ওদের থেকেও ছোটো বয়সি – এই ডিসেম্বরের অনুষ্ঠানের কথা জানে। এই অনুষ্ঠান ওদের সবার ভবিতব্য।
“আমি খুব আনন্দিত যে তুমি তোমার অনুভূতিটা আমাদের সাথে ভাগাভাগি করেছ, জোনাস।” বলেন ওর বাবা।
“লিলি,” ওদের মা বলেন, হাত নাড়িয়ে চলে যাবার ইশারা করেন, “যাও, গিয়ে ঘুমানোর পোশাক পরে নাও। বাবা আর আমি এখন জোনাসের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলবো।”
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে লিলি। তবে মায়ের কথা মেনে চেয়ার ছেড়ে ওঠে পড়ে, “শুধু জোনাসের সাথে?”
মাথা ঝোঁকান মা, “হ্যাঁ, শুধু জোনাসের সাথে।”
প্রথম অধ্যায় শেষ। কেমন লাগল জানাতে পারেন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।
বইটি অর্ডার করতে ক্লিক করুন এখানে বা কল করুন ০১৫৭২১৫৯২৬৯ নাম্বারে অথবা ম্যাসেজ দিতে পারেন আমাদের ফেসবুক পেইজে।
Comments (0)